Skip to main content

বাংলাদেশ: নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধের কার্যকরি সময়

নীতিগুলি কার্যকর করুন, পরিষেবা সরবরাহ করুন, বিচার ব্যবস্থাতে বাধা এবং দুর্নীতি রোধ করুন

৮ ই মার্চ, ২০১৯, ঢাকা, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস উপলক্ষে নারীরা মোমবাতি প্রজ্জলনে অংশ নিচ্ছেন। © ২০১৯ রেহমান আসাদ/বারক্রফ্ট মিডিয়া ভায়া গেট্টি ইমাজেস

(নিউ ইয়র্ক) - বাংলাদেশের নারী ও মেয়েরা কোভিড -১৯ মহামারী চলাকালীন সময়ে বেশি মাত্রায় পারিবারিক সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে, যা আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ, সুরক্ষা এবং সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিগত বাধাগুলিকে দৃষ্টিগোচর করছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ বলেছে। বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে "নারী ও শিশু নির্যাতনহীন একটি সমাজ গঠনের" জাতীয় পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রবেশের পরে এই সংকট দেখা দিয়েছে।

এই লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশী নারী এবং মেয়েরা তাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। একজন নারী অধিকার বিষয়ক আইনজীবীর মতেঃ “সমাজ পারিবারিক সহিংসতাকে তুচ্ছ  সহিংসতা বলে মনে করে, এটা এমন যে এ ধরনের ঘটনা পরিবারে স্বাভাবিকভাবেই ঘটে থাকে।“ 

৬৫ - পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে, "আমি আমার নিজের মৃত্যুশয্যায় ঘুমাই": বাংলাদেশে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা," নারী এবং শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছাড়াই একটি সমাজের সরকারের লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে যে বাধা রয়েছে তা নথিভুক্ত করতে ৫০ টি সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পর্যবেক্ষনে উঠে এসেছে যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও, সরকারের প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে অপ্রতুল রয়ে গেছে, হামলার খবর জানাতে বা আইনি পথ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধাগুলি প্রায়শই দুর্গম হয়ে থাকে এবং ভুক্তভোগীদের জন্য পরিষেবাগুলি  সীমিত।

"কোভিড -১৯ মহামারীর সময় নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতার উর্ধগতি এবং যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক প্রতিবাদগুলি, বাংলাদেশ সরকারের জন্য গলায় একটি ঘন্টা বেজে ওঠার মত বিষয় যেখানে জরুরি কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন," বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি। "সরকারের উচিত দেশজুড়ে সুলভ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা, আইনি সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করা, এবং সহিংসতার প্রতিবেদন এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা।"

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এসিড সহিংসতায় আক্রান্ত এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতায় বেঁচে থাকা বাংলাদেশের আট বিভাগের মধ্যে ছয়টি থেকে ২৯ জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সরকার এসিড সহিংসতার বিষয়টিকে যদিও অগ্রাধিকার হিসাবে চিহ্নিত করেছে, তারপরেও এই ঘটনাগুলি লুকিয়ে থাকা পদ্ধতিগত বাধাগুলি সামনে এনেছে  যা এখনও এই বেঁচে থাকা নারীদের আইনি সমর্থন এবং সুরক্ষা পেতে বাধা দেয়। এর বাইরেও আমরা মামলার নথিপত্রগুলি পর্যালোচনা করেছি এবং নারী অধিকার বিষয়ক কর্মী, আইনজীবি এবং এসিড সহিংসতা, নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা এবং বাংলাদেশে আইনি সংস্কার নিয়ে কাজ করা শিক্ষাবিদদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।

নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের সংকট বৃদ্ধিতে সম্প্রতি যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা উঠে আসার পর বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে যার ফলে সরকারের ব্যর্থতার   দিকগুলি উঠে আসে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী এবং মেয়েরা নানা মাত্রার  লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতায় শিকার হচ্ছে। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (Bangladesh Bureau of Statistics) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত মহিলা বা মেয়েরা সঙ্গীদের থেকে নানা মাত্রার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বলেছে যে তাদের সঙ্গীরা তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে, এবং তবুও বেশিরভাগই বলেছে যে তারা কখনই কাউকে কিছু বলেনি এবং তিন শতাংশেরও কম ভুক্তভুগী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে কমপক্ষে ২৩৫ জন নারীকে তাদের স্বামী বা স্বামীর পরিবার হত্যা করেছে বলে জানা গেছে।

এই বছর, বাংলাদেশ লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কিত দুটি যুগান্তকারী আইনগুলির বার্ষিকী উৎযাপন করেছে: নারী-ও-শিশু নির্যাতন দমন আইন (Women and Children Repression Prevention Act), ২০০০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে যে  নারী এবং মেয়েরা প্রায়শই এই আইনের অধীনে অর্থবহ আইনি প্রতিকারের সন্ধান করতে পারেন না এবং নির্যাতনকারীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা যায়। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মাল্টি-সেক্টরাল প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুসারে, নারী ও মেয়েদের জন্য সরকারের নয়টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কোনো একটির মাধ্যমে আইনী মামলা দায়ের করা ১১,০০০ এরও বেশি নারীর মধ্যে কেবল ১৬০ টি ঘটনায় সফলভাবে দণ্ডাদেশ এসেছে— যা প্রায় এক শতাংশ।

যেসব বেঁচে থাকা নারীদের সাক্ষাৎকার আমরা নিয়েছি তারা প্রায়শই বলেছে যে তারা এসিডে আক্রান্ত হওয়ার আগে তাদের স্বামী বা শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা শারীরিক ও মৌখিকভাবে কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক বছর ধরে নির্যাতন চালিয়েছে, কিন্তু তাদের কোন প্রকার সমর্থন না থাকায় এবং সহিংসতা থেকে পরিত্রাণের জন্যে কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকায়, তাদের কেউই পুলিশের কাছে এই সহিংসতার বিষয়ে রিপোর্ট করেনি। ৮ কোটিরও বেশি নারী এবং ৬ কোটি ৪০ লক্ষ শিশুদের জনসংখ্যার জন্য আনুমানিক ২১ টি সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র এবং ১৫ টি এনজিও-পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সন্ধানে জানা গেছে, অনেক বেঁচে যাওয়া নারীরা নিজেদেরকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া হবে কিনা ভেবে নির্যাতিত হবার বিষয়টি জানায় না এবং তারা আশঙ্কা করে যে নিরাপদ আশ্রয়, সাক্ষী সুরক্ষা, বা অন্যান্য সহায়তা সেবা না থাকলে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করা কেবল তাদের আরও গভীরতর বিপদে ফেলতে পারে।

২৪ বছর বয়সী সালমা বলেছেন যে ২০১৫ সালে তার বাবা-মা তার স্বামীর পরিবারকে যৌতুক দেবার পরেও, তার শ্বশুর তাকে আরও টাকা চেয়ে বারবার মারধর করত। তার বাবা-মা বলেছিলেন, "তোমাকে কেবল সহ্য করতে হবে" এই যন্ত্রণা এবং তার বাবা পুলিশের কাছে সহায়তা চাওয়ার বিষয়ে তাকে (সালমা) সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। অবশেষে, তার স্বামী এবং তার (স্বামীর) বাবা-মা তাকে জোর করে চেপে ধরে তার গলায় এসিড ঢেলে দিয়েছিল।

নারীরা যখন পুলিশের কাছে যান, তারা প্রায়শই পুলিশের অবিশ্বাস এবং একরোখা মনোভাবের সম্মুখীন হয়। সাদিয়া, (২৮), বলেছেন যে তার ১২ বছরের বিবাহিত জীবনে তার স্বামী তাকে নিয়মিত মারধর করত, কিন্তু সে পুলিশকে কখনও এই সহিংসতার খবর জানাতে নিরাপদ বোধ করেনি কারণ তিনি বিশ্বাস করেন না যে পুলিশ তাকে কোনো ধরনের সহায়তা করবে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে তার স্বামী তাকে এসিড দিয়ে আক্রমণ করলে পুলিশ তাকে অবিশ্বাস করে। এমনকি তার বাম চোখ এবং বাম কানটি হারিয়ে যাওয়ার পরেও, দায়িত্বরত কর্মকর্তা তাকে বলেছিলেন, "আমি মনে করি না সে (সাদিয়ার স্বামী) এই কাজটি করেছে, তাই আমরা তাকে ছেড়ে দিচ্ছি।"

নারী অধিকার বিষয়ক আইনজীবিরা বলেছেন যে পুলিশ প্রায়শই প্রতিবেদন দায়ের করতে অস্বীকার করে বা বছরের পর বছর মামলাগুলো উন্মুক্ত তদন্তের জন্যে ফেলে রাখে। প্রায়শই যখন কোন নারী বা মেয়ে পুলিশকে তাদের লাঞ্চিত হবার বিষয়ে জানায়, তখন তারা (পুলিশ) দাবি করে যে সে (নারী/মেয়ে) যেনো বার বার নির্যাতনের বিষয়টি বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে বর্ণনা করে যা তাকে পুনরায় মানসিকভাবে আঘাত করে এবং বেঁচে থাকা নারীদের ন্যায়বিচার চাইতে নিরুৎসাহিত করে।

প্রায় ৩৭ লাখ (৩.৭ মিলিয়ন) মামলা জমে থাকার কারণে এই সমস্যাটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে, বিচারগুলি প্রায়শই বিলম্বিত হয় বা বছরের পর বছর ধরে টানা হয়। কোনও সাক্ষী সুরক্ষা আইন বা ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত, নির্যাতনকারীদের ভয় বা হুমকির সাথে সাথে আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক ও মানসিক চাপ থেকে বেঁচে থাকা নারীদের প্রায়শই এমন আদালতের বাইরে আলোচনা মাধমে মীমাংসার জন্য চাপ দেওয়া হয় যা তাদের ক্ষতিগুলির যথাযথ প্রতিফলন ঘটায় না।

পাবলিক প্রসিকিউটররা দুর্বলভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, প্রায়শই চাকরিতে সেই প্রশিক্ষণের ব্যবহার করেন না এবং অনেক সময় দুর্নীতিগ্রস্থ হন। একজন আইনজীবী যিনি আদালত পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করতেন তিনি বলেছেন যে তিনি যখন আদালতে ছিলেন, তখন তিনি এমন ঘটনা লক্ষ্য করেছেন যে, মামলাটি যেন উঠে  যায় সেই জন্যে নির্যাতনকারীর পরিবার সরাসরি পাবলিক প্রসিকিউটরকে ঘুষ হিসেবে অর্থ প্রদান করে। "এটি একটি ওপেন সিক্রেট," তিনি জানিয়েছেন ।

বাংলাদেশে, নারীরা খুব কমই তথ্য এবং আইনি পরামর্শের যথাযথ সুবিধা পেয়ে থাকে যা বিশেষত তাদেরকে এ জাতীয় দুর্নীতি ও নির্যাতনের শিকার করে তোলে। বিশেষ করে সেই সকল মহিলাদের জন্যে আইনি সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে পরে যারা স্বামীর উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল - যে কিনা আবার  তাদের নির্যাতনকারী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত মেয়েদের ও নারীদের প্রতি সহিংসতার জন্য দায়ীদের প্রতিরোধ, তদন্ত, বিচার, এবং শাস্তি প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক আইন, নিজস্ব সংবিধান এবং দেশীয় আইনের অধীনে তার বাধ্যবাধকতাগুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা এবং বেঁচে থাকা নারীদের সহায়তা করা। অক্ষম এবং দুর্নীতিজনিত স্থানীয় বিচার ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে উপড়ে ফেলা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

কর্তৃপক্ষের উচিত গুরুতর প্রতিরোধ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা, যেমন বিস্তৃত শিক্ষা এবং সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা এবং মানসিক সহায়তা, নিরাপদ আশ্রয় এবং আইনি সহায়তার মত সহজগম্য সেবাসমূহ সরবরাহ করা।

“বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা নারী ও মেয়েদের ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে ,” গাঙ্গুলি বলছিলেন। “বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন। সরকারের উচিত এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটিকে অবলম্বন করে সত্যিকারের সংস্কার বাস্তবায়ন করা যা জীবন বাঁচাতে পারে এবং সমাজে সমতা আনতে পারে।“

 

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country