Skip to main content

বাংলাদেশ: রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারগুলোকে পুনরায় একত্রিত করে দিন

ভাসান চরে বন্দীদের কক্সবাজার ক্যাম্পগুলিতে ফিরিয়ে দিন

কক্সবাজার শিবির থেকে ৪০ জন শরণার্থীর তিন দিনব্যাপী "যাও এবং দেখো ভ্রমণ" চলাকালীন সময়ে ভাষানচরে থাকা শরণার্থীরা কক্সবাজার ফেরত যাবার জন্যে প্রতিবাদ জানায়, বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর ৫,২০২০ © 2020 Private

(নিউইয়র্ক)—হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ বলেছে, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যন্ত এলাকায়, ভাসান চরের মত অরক্ষিত দ্বীপে, না রাখার প্রতিশ্রুতি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, সরকার রোহিঙ্গা শিবিরের নেতৃবৃন্দসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য ভাসান চরে তিন দিনের “যান এবং দেখুন ভ্রমণ” ব্যবস্থা করেছিলেন, এই সময় দ্বীপে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের শিবিরে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আকুতি জানিয়েছিল।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৮ই সেপ্টেম্বর ভাসান চর থেকে সফর শেষে কক্সবাজারে ফেরত আসার পর সফরকারী প্রতিনিধি দলের ২০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাত্কার নিয়েছিল। কেউ কেউ বলেছে তারা চেয়েছিল দ্বীপে আটক শরণার্থীদের তাদের সাথে ফিরে যেতে দেওয়া হোক। অন্যরা এই দ্বীপে চিকিৎসা সুবিধার গুণমান, জীবিকার সুযোগের অভাব এবং বর্ষা মৌসুমে দ্বীপের সুরক্ষা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

"বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ ও বাসযোগ্য বলে দাবি করার প্রচেষ্টায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিবার থেকে পৃথক করে তাদেরকে প্রত্যন্ত দ্বীপে আটক করে রেখেছে," বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস। "কেবল দীর্ঘ প্রতিশ্রুত জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করার অনুমতি দিয়েই ভাসান চরে ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্যতা, সুরক্ষা এবং স্থায়িত্ব নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।"

জাতিসংঘের সংস্থা বা বেসরকারী সংস্থাগুলির পরামর্শ ছাড়াই এই সফরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভাসান চরে কমপক্ষে ৩৩ শিশুসহ আটককৃত ৩০৬ জন শরণার্থীর জন্য সুরক্ষিত সফর করার জন্য সরকার এখনও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার কর্মকর্তাদের অনুমতি দেয়নি।

বাংলাদেশ সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে রোহিঙ্গাদেরকে দ্বীপে স্থানান্তরিত করার আগে তারা জাতিসংঘের সংস্থা এবং স্বাধীন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জরুরি প্রস্তুতি, আবাসস্থল এবং দ্বীপের সুরক্ষার বিষয়ে ছাড়পত্রের অপেক্ষা করবে। এই দ্বীপ পরিদর্শনকারী রোহিঙ্গা শিবিরের এক নেতা বলেছিলেন যে শরণার্থীরাও বিশেষজ্ঞের মূল্যায়নের অপেক্ষায় ছিল: "আমরা চাই জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ভাসান চর পরিদর্শন করুক এবং আমাদেরকে জানিয়ে দিক যে এটি নিরাপদ কিনা।" এদিকে কক্সবাজারের শরনার্থীরা বলছে যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দ্বীপে চলে যাওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে যদি তারা তাদের পরিবারকে আবার কখনও দেখতে চায়।

দর্শনার্থীদের মধ্যে যাদেরকে একবার এই দ্বীপে তাদের আত্মীয়দের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তারা বলেছিলেন যে যাঁরা আটক রয়েছেন তারা কক্সবাজার শিবিরে ফিরে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দু'জন সফরকারী প্রতিনিধি সদস্য বলেছিলেন যে একজন মহিলা তার ভাইকে পুনরায় দেখার পর পাগলের মত হয়ে পড়লে বাংলাদেশ নৌবাহিনী অফিসাররা তাকে মারধর করে, যার ফলে তার মাথা একটি দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তার ভাই, যিনি প্রতিনিধি দলের অংশ ছিলেন, তিনি বলেছেন: “আমরা যখন সাক্ষাত করি তখন তারা সকলেই অনুনয় ও কান্নাকাটি করে আমাদেরকে বলছিল যে তাদেরকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আমার বোনকে সেই কারাগারের মতো দ্বীপে একা রেখে আসতে আমি অসহায় বোধ করেছিলাম।“ প্রতিনিধি দলের একজন মহিলা বলছিলেন: "আমি যে সকল নারীদের সাথে কথা বলেছিলাম তাদের বেশিরভাগই বলেছিল যে তাদের একমাত্র ইচ্ছা হল ভাসান চর ছেড়ে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসা।"

প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য বলেছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ "[সফরকারীদের] পুরো ভ্রমণে সর্বাধিক আতিথেয়তা সহ ভাল খাবার এবং সুন্দর থাকার জায়গাগুলি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল।" তবে সদস্যরা বলেছেন যে স্বেচ্ছাসেবী স্থানান্তরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এটিকে শো-য়ের মতো মনে হয়েছিল, অথচ দ্বীপে যারা ইতিমধ্যে রয়েছেন তারা খারাপ আচরণের কথা জানিয়েছেন।

অন্য একজন প্রতিনিধি সদস্য বলেছিলেন, "সেখানে উপস্থিত লোকেরা আমাদের কাছে অভিযোগ করে বলেছিল যে তাদের সাথে এত ভাল ব্যবহার কখনই করা হয়নি এবং যেই মাত্র আমরা কক্সবাজারে ফিরে এসেছি, সেই ভাই-বোনদের সাথে এখন আগের মতো আচরণ করা হচ্ছে।" পূর্বে, দ্বীপের শরণার্থীরা বলেছিলেন যে তাদের অবাধে চলাচল করতে দেওয়া হয়নি এবং খাবার বা চিকিত্সা সেবার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল না। কিছু শরণার্থী অভিযোগ করে বলেছেন যে দ্বীপে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের মারধর করেছে এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।

পরিদর্শকগণ নিশ্চিত করে বলেছিলেন যে দ্বীপে যারা অবস্থান করছে তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা বঞ্চিত করা হয়েছে। "আপনি সেখানে 'কারাগার' শব্দটি খুঁজে পাবেন না, কিন্তু সবকিছুই কারাগারের মত দেখতে," একজন প্রতিনিধি সদস্য বলেছেন। "ভাসানচরে অবস্থানরত অধিকাংশ শরণার্থী আমাদেরকে বলেছে যে তারা দ্বীপের মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অনুমতি পায়না এবং অধিকাংশ সময় তাদের আশ্রয়স্থলের ভেতরেই থাকতে হয় যেটি কারাগারের কক্ষের মতই দেখতে।"

অন্য এক রোহিঙ্গা প্রতিনিধি সদস্যকে শরণার্থীরা বলেছে যে দ্বীপের কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের একত্রিত হয়ে মসজিদে তাদের প্রার্থনা করার অনুমতি দেয়না এই দাবী করে যে এতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে, যদিও কর্তৃপক্ষ চার মাসের বেশি সময় যাবত প্রত্যেককে পৃথক করে রেখেছে। তিনি বলেছেন, "যদি তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে অবকাঠামো নির্মাণ করে থাকে, তাহলে কেন তারা মসজিদের ভেতরে অনুমতি পাবে না।“ 

পরিদর্শনে আসা শরণার্থীরা দ্বীপের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার অভাব নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একজন ব্যাক্তি বলেছেন, "দ্বীপে থাকা শরণার্থীদের অনেকেই আমাদের বলেছিল যে তারা শিবির কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যথাযথ ঔষধ পাচ্ছে না এবং দ্বীপের স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত," একজন ব্যক্তি বলেন। “যদি কেউ মারাত্নকভাবে অসুস্থ হয়ে পরে, সেক্ষেত্রে সবথেকে কাছাকাছি উপায় হলো একটি হাসপাতাল যেটি তিন-চার ঘন্টার নৌকা ভ্রমণের পথ।" সে জানায় কিছু শরণার্থী কিছু দিন আগে তাকে বলেছে, একজন শরণার্থী অজ্ঞান হয়ে পরেছিলো, এবং কর্তৃপক্ষ তাকে নৌ-হেলিকপ্টারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাস্থ্যসেবার জন্যে পাঠায়। "আমার মনে হয় না বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সবসময় রোহিঙ্গাদের জন্যে সামরিক হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করবে,“ তিনি বলেছেন।“ " আমরা শিবিরেও (কক্সবাজার) অসুস্থ হয়ে পরতে পারি কিন্তু সেখানে অন্তত স্বাস্থ্যসুবিধা এবং সংস্থা আছে যারা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে।"

কিছু শরণার্থী যারা ভাষানচর পরিদর্শন করেছেন, জানায় যে দ্বীপে থাকা নারী ও মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার জন্যে উপযুক্ত স্যানিটারি পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যরা জানায় যে দ্বীপে দীর্ঘস্থায়ী জীবিকার দৃশ্যমান অভাব নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। পরিদর্শকের মধ্যে একজন বলেন, "বসবাসযোগ্য স্থান হিসেবে আমি কখনোই ভাষানচরকে বাছাই করবো না। আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি যে সেখানে জীবিকা নির্বাহের জন্যে কিছুই করার নেই। কর্তৃপক্ষ কিভাবে প্রতিটি দিক থেকে বাঁধ দেয়া একটি অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের কৃষিকাজ এবং খামার করতে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে ।"

যখন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার দ্বারা পরিচালিত  "যান এবং দেখুন" পরিদর্শনগুলি সাধারণত শরণার্থীদের তাদের স্বদেশে নিরাপদ, সেচ্ছাকৃত এবং মর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যাবর্তন সহজতর করার জন্যে সংগঠিত পদক্ষেপগুলোর একটি। এটাকে  এককভাবে মূল্যায়ন হিসেবে ধরা হয়না এবং প্রত্যাবর্তনকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সেখানে একাধিক মানবিক মূল্যায়ন করতে হয়। যদি বাংলাদেশ সরকার শরণার্থীদের ভাষানচরে স্থানান্তরের এই ধারণা কাজে লাগাতে চায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে এর জন্য বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের দ্বীপ পরিদর্শনের অনুমতি দেয়া।

প্রায়ই বসবাসের অযোগ্য দূরবর্তী দ্বীপে মানবিক সহায়তা অথবা মৌলিক সেবা ছাড়া হাজারো শরণার্থীদের সেচ্ছাচারীভাবে আটক তাদের নিরাপত্তা, চলাচলের স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ এবং কাজ করার অধিকার প্রদানের জন্যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাধ্যবাধকতাকে লংঘন করে।

"পরিদর্শকদের জন্যে জাঁকজমক এবং অভিনব ভোজন ব্যবস্থার পরিবর্তে সরকারের উচিত শরণার্থীদের সর্বাধিক মৌলিক আবেদনগুলো শোনা যেন তারা নিরাপদভাবে তাদের পরিবারের সাথে একত্রিত হতে পারে।" অ্যাডামস বলেছেন। "বাংলাদেশ সরকারের উচিত শরণার্থীদের কক্সবাজারে তাদের পরিবারের কাছে নিয়ে আসা এবং দ্বীপ নিয়ে পরিকল্পিত জাতিসংঘের স্বাধীন মূল্যায়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার মাধমে তাদের মূল প্রতিজ্ঞা অনুসরণ করা।"

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country
Tags